স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষের পর আজ সোমবারও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে। দুই দফা সংঘর্ষের ঘটনায় আজ সকাল পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি। ক্যাম্পাসজুড়ে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। তবে প্রশাসনিক ভবনে নিয়োগ পরীক্ষা এবং অন্যান্য দাপ্তরিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮টি বিভাগ ও ৬টি ইনস্টিটিউটে প্রায় ২৭ হাজার ৫৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। সংঘর্ষের পর গতকাল রোববার সব বিভাগের পরীক্ষা স্থগিত করা হয় এবং ক্লাসও তেমন হয়নি। তবে নিয়োগ পরীক্ষা যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ সকালে সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, শহীদ মিনার, গোল চত্বর এবং দুই নম্বর গেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুরো ক্যাম্পাস অনেকটাই ফাঁকা। কিছু জায়গায় দু-একজন শিক্ষার্থী দেখা গেলেও, স্বাভাবিক সময়ের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ ছিল অনুপস্থিত।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত বাস এবং শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের প্রধান বাহন শাটল ট্রেন যথারীতি চালু রয়েছে। ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, “গতকালের পরিস্থিতি বিবেচনায় আজ ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তবে শিক্ষকদের বাস স্বাভাবিক সূচি অনুযায়ী চলাচল করছে। আগামীকাল ক্লাস-পরীক্ষা হবে কি না, তা শিগগিরই জানিয়ে দেওয়া হবে।”
এর আগে শনিবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে শুরু হয়ে রোববার দুপুর ৩টা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ও ক্যাম্পাসসংলগ্ন জোবরা গ্রামের বাসিন্দারা। দীর্ঘ এ সংঘর্ষে দুই পক্ষের অন্তত ২২০ জন আহত হন, যাঁদের মধ্যে প্রায় ২০০ জনই শিক্ষার্থী।
সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে এক ছাত্রীকে একটি বাসার দারোয়ান মারধর করেছেন—এমন খবরে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও মো. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফসহ একাধিক শিক্ষক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। দ্রুতই দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি শুরু হয়।
ঘটনাস্থলে রড, লাঠি, পাইপ ও পাথরসহ শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি হয় গ্রামবাসীদের, যাঁদের হাতে ছিল রামদা, রড ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র। জোবরা গ্রাম পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের অলিগলিতেও। অনেক শিক্ষার্থী সেখানে আটকা পড়ে মারধরের শিকার হন। ধারালো অস্ত্রে গুরুতর আহত অবস্থায় অনেক শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রোববার দুপুর ২টার দিকে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন ক্যাম্পাস এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
সংঘর্ষে গুরুতর আহত তিন শিক্ষার্থী বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের দুটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন আইসিইউতে আছেন।
এ ঘটনায় আজ সকাল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু কাওছার মোহাম্মদ হোসেন। তিনি বলেন, “সংঘর্ষের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি, কেউ আটকও হয়নি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আশা করছি, আগামীকাল থেকে ক্লাস-পরীক্ষা স্বাভাবিক হবে। আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করছে—হাসপাতাল হোক বা ক্লিনিকে, যেখানেই তারা চিকিৎসাধীন থাকুক।”
ঘটনার সূচনাপর্ব
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এক ছাত্রী ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেটের কাছে একটি ভবনে ভাড়া থাকেন। শনিবার দিবাগত রাত সোয়া ১২টার দিকে তিনি ওই ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করলে ভবনের দারোয়ান তাকে মারধর করেন। ২ নম্বর গেটে থাকা শিক্ষার্থীরা দারোয়ানকে ধরার চেষ্টা করলে তিনি পালিয়ে যান। এরপর শিক্ষার্থীরা দারোয়ানকে ধাওয়া করলে স্থানীয় লোকজন ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করেন। এ সময় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়।
ওই ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, “বাসায় ফেরার পর দারোয়ানকে দরজা খুলতে বললে তিনি তা করতে অস্বীকার করেন। পরে জোরে ডাক দিলে তিনি গালাগাল শুরু করেন। আমি প্রতিবাদ করলে হঠাৎ চড় মারেন। তখন আমার রুমমেটরা নামলে তিনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন এবং লাথি মারতে থাকেন। তখন রুমমেট এবং আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসেন।”
ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন জোবরা গ্রামে জমায়েত হন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে সংঘর্ষে পরিণত হয়। শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলে দুই পক্ষ কিছুটা সরে যায়, তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। রাতভর চলা সংঘর্ষে অন্তত ৭০ জন আহত হন, যাদের মধ্যে কমপক্ষে ১০ জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। রাতের ওই ঘটনার পর স্থানীয়রা ২ নম্বর গেট থেকে জোবরা হয়ে চট্টগ্রাম-হাটহাজারী মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেন।