“আমার ভাইয়ের খুলির হাড় এখনও জোড়া লাগেনি, অথচ হাসপাতাল করিডোরে তাকে হাঁটিয়ে ভিডিও ও ফটো করা হয়েছে। তাকে ‘ভাল’ দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যদিও সে কাউকে চিনতেই পারছে না। আমি রুমে কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে ছিলাম, ফিরে জানতে পারলাম মামুনকে হাঁটানো হয়েছে। এ দৃশ্য দেখেই আমার মনটা ভেঙে পড়ল।”
এই কথাগুলো হাতে টেকিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাসুদ রানা তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মামুন মিয়ার বড় ভাই এবং স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে গুরুতর আহত মামুনের ছেলে। আজ রবিবার সকালে নগরের পার্কভিউ হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে কথা হয়; কথা বলাকালীন তিনি বারবার ভাইয়ের কক্ষে দেখা যাচ্ছিল মন ছুঁয়ে যাওয়া দৃশ্য।
গতকাল রাতে সামাজিক মাধ্যমে “মামুন সুস্থ” দাবি করে ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে দৃশ্যটিতে দেখা যায়, কেউ কাঁধে ভর দিয়ে তাকে করিডোরে হাঁটাচ্ছে। এই ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর সমালোচনা শুরু হয়; স্বজন ও সহপাঠীরা অভিযোগ করেন, তাঁকে জোর করে “সুস্থ দেখানো” হচ্ছে।
স্বজন ও সহপাঠীদের বরাত দিয়ে জানা যায়, “মামুন এখনও কাউকে চিনতে পারছে না; মাথায় ব্যথা হলে চিৎকারও করতে থাকে। এমন অবস্থায় তাকে হাঁটিয়ে ছবি ও ভিডিও করার ঘটনা সবার মন কষ্টে ফেলেছে।”
মামুন ৩১ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের সময় মাথায় ধারালো অস্ত্র কর্তৃক গুরুতর আহত হন। সেই রাতেই অস্ত্রোপচার করা হয় এবং কয়েক দিন ICU-তে ছিলেন; পরবর্তীতে কেবিনে নেয়া হয়, যেখানে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাঁর খুলির হাড় এখনও সংরক্ষিত আছে, ফ্রিজে রাখা হয়েছে। কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও, এখনও কেউ চিনতে পারেন না তিনি। মাসুদ রানা বলেন, “সে শুধু বলছেন,‘ভাল্লাগে না’, ‘মইরা যাব’... তবে আমার আসলে কানে ইশারায় কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন।”
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আতিয়ার রহমান ফেসবুকে অবশ্য লিখেছেন, “পার্কভিউ হাসপাতালে মামলা দেখতে আসি; আল্হামদুলিল্লাহ, মামুন হাঁটছে, একটু কথা বলছে,অপারেশনে জড়িত নিউরোসার্জন তাঁকে হাঁটিয়েছেন, এতে কিছুটা স্বস্তি পেলাম।”
অন্যদিকে, সহপাঠী রাসেল রানা জানান, “শনিবার বিকেলে যখন আতিয়ার স্যারসহ কয়েকজন কেবিনে ঢুকতে চাইলেন, আমি আটকালাম; পরে ডাক্তার তাদের কাছে ঢুকতে দেন, এবং মামুনকে বসিয়ে ছবি-ভিডিও করা হয়। এক ঘণ্টা পর দেখি ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে যাচ্ছে, এবং ‘সুস্থ’ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ সারা রাত ওর পাশে ছিলাম সে তো অচেতন ছিল।”
হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেছেন, “এটা ছিল রুটিন কাজ রোগীর আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য হাঁটানো হয়েছিল।”
এ লড়াইয়ে ভর্তি আছেন আরো একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ যিনি ১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন; জ্ঞান এখনও পুরোপুরি ফেরা হয়নি। গতকাল দুপুরে তাঁর তৃতীয় দফা মেডিক্যাল বোর্ড বসেছে। ভাই আসাদুজ্জামান সজীব জানিয়েছেন, “জ্ঞান ফেরেনি; আগে হাত-পা নাড়াচাড়া করছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।”
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে, প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, এই সংঘর্ষ শুরু হয় ৩০ আগস্ট রাত সোয়া ১২টা থেকে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেটের কাছে স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ এবং ধাওয়া পাল্টা সংঘর্ষ হয়; ঘটনায় আহত হন প্রক্টর, সহ-উপাচার্য, শতাধিক শিক্ষার্থী এবং কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা।