ঢাকায় মেট্রোরেল শুধু যাতায়াত ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তই উন্মোচন করেনি, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আয়–ব্যয়ের বড় চ্যালেঞ্জ। টিকিট বিক্রির আয়ে ঋণের কিস্তি ও বাড়তি পরিচালন ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিকল্প আয়ের পথ খুঁজছে কর্তৃপক্ষ।
ইতিমধ্যে স্টেশনভিত্তিক দোকান, ব্যাংক বুথ ও বিজ্ঞাপনের জায়গা ভাড়া দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৩১টি দোকান ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মত, এসব বাণিজ্যিক ব্যবস্থা যেন যাত্রীসেবার মান কমিয়ে না দেয়, সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে।
মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) জানায়, বর্তমানে অনেক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় প্রকল্প থেকে বহন করা হচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী এ সুবিধা থাকলেও আগামী বছর থেকে তারা আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে না। ফলে পরিচালনা ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। এই অবস্থায় আয় না বাড়াতে পারলে মেট্রোরেল পরিচালনায় চাপ তৈরি হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মেট্রোরেলে যাতায়াতের ওপর সরকার এখনো ভ্যাট মওকুফ রাখলেও আশপাশের দেশের তুলনায় ঢাকার মেট্রোরেল ভাড়া তুলনামূলক বেশি। ফলে ভাড়া বাড়িয়ে রাজস্ব বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত। তাদের পরামর্শ, যাত্রার সংখ্যা বাড়ানো, স্টেশনের পাশে গাড়ি পার্কিং সুবিধা চালু করা এবং বিপণিবিতান ভাড়া দেওয়ার মতো উদ্যোগই হতে পারে আয়ের ভালো বিকল্প।
শুরুর দিকে আয় বাড়াতে ডিএমটিসিএল মেট্রোরেলের স্থাপনায় বিজ্ঞাপনের সুযোগ করে দেয়। এর অংশ হিসেবে ট্রেনের ভেতরের মনিটরে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন প্রচার, দেয়ালে পোস্টার এবং প্ল্যাটফর্ম ট্রেনের মাঝের স্লাইড ডোরে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে স্টেশনভিত্তিক ব্যাংক বুথ ভাড়া দিয়েও আয় শুরু করে কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে ঢাকা মেট্রোরেলের বিভিন্ন স্টেশনে ১১টি ব্যাংকের মোট ১৪৪টি এটিএম ও ব্যাংকিং বুথ স্থাপন করা হয়েছে। একাধিক স্টেশনে একাধিক ব্যাংকের বুথ রয়েছে, যা উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব বুথ থেকে ভাড়া বাবদ আয় করছে ডিএমটিসিএল।
এ ছাড়া উত্তরা (উত্তর), আগারগাঁও, ফার্মগেট ও কমলাপুর এই চারটি স্টেশনের নিচে পর্যাপ্ত অব্যবহৃত জায়গা রয়েছে। সেখানে ‘স্টেশন প্লাজা’ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যার আওতায় থাকবে ব্যক্তিগত গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ও দোকান বরাদ্দ। তবে এতে যানজট সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কায় এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ জানান, যাত্রীদের ওপর অতিরিক্ত ভাড়ার বোঝা চাপানো হবে না। বরং মেট্রোরেলের পূর্ণ সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে আয়ের পরিমাণ বাড়ানোই এখন মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি দোকান ও ব্যাংকের বুথ ভাড়া, বিজ্ঞাপন প্রচারসহ বিকল্প উৎস থেকে আয় বাড়ানোর চেষ্টা চলছে, যাতে পরিচালন ব্যয়ের চাপ কিছুটা কমানো যায়।
এদিকে, উত্তরা (উত্তর) থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৪টি স্টেশনের মধ্যে আগারগাঁও ও কারওয়ান বাজার ছাড়া বাকি স্টেশনগুলোতে ৩১টি দোকান ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএমটিসিএল। এসব দোকান স্টেশনের কনকোর্স হলের নন-পেইড এলাকায় অবস্থিত, যেগুলো এখন লাল শাটার দিয়ে ঢাকা রয়েছে। ইজারা প্রক্রিয়া শেষ হলে, ইজারাদার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ উদ্যোগে দোকান সাজাবে। এ জন্য একটি নির্দিষ্ট নীতিমালাও প্রণয়ন করেছে কর্তৃপক্ষ।
মেট্রোস্টেশনে দোকান নিতে হলে যা লাগবে:
মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর বাণিজ্যিক দোকানের জন্য আবেদন করতে হলে ব্যবসার পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। কোন পণ্য বা সেবা বিক্রি করা হবে, কীভাবে দোকান পরিচালনা হবে, কত জনবল লাগবে এসব বিস্তারিত তথ্য পরিকল্পনায় থাকতে হবে। স্টেশনের নিরাপত্তা ও সৌন্দর্যের দিকটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাবে।
চুক্তির প্রাথমিক মেয়াদ হবে ৫ বছর। আবেদন করার সময় বার্ষিক ভাড়ার ১৫% জামানত হিসেবে জমা দিতে হবে। চুক্তি সইয়ের আগে আরও ২০% নিরাপত্তা জামানত ও এক বছরের অগ্রিম ভাড়া দিতে হবে। প্রতিবছর ভাড়া ৫% হারে বাড়বে।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত যেসব আবেদন জমা পড়েছে, বেশিরভাগই ফাস্টফুড ও কফিশপের জন্য। তবে নিরাপত্তার কারণে দোকানে গ্যাসের চুলা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে না।
দোকান বরাদ্দের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতাকে বেছে নেওয়া হবে। প্রয়োজনে দরদাতাদের সঙ্গে আলোচনাও হতে পারে। ডিএমটিসিএলের একজন কর্মকর্তা জানান, ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্টেশনের অবস্থান ছাড়াও মেট্রোরেলের ব্র্যান্ড মূল্য বিবেচনায় নেওয়া হবে।
কোন স্টেশনে কতটি দোকান:
স্টেশনভেদে দোকানের আয়তন ২০০ থেকে ২,০০০ বর্গফুট পর্যন্ত।
বরাদ্দসংখ্যা:
উত্তরা উত্তর স্টেশন: ৪টি
পল্লবী, কাজীপাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়: ৩টি করে
উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, মিরপুর-১১, শেওড়াপাড়া, বিজয় সরণি, মতিঝিল: ২টি করে
ফার্মগেট, শাহবাগ, মিরপুর-১০: ১টি করে
আয়-ব্যয়ের চিত্র:
২০১২ সালে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৩,৪৭২ কোটি টাকা, যার ৫৯% ঋণ দিয়েছে জাপানি সংস্থা জাইকা।
২০২৩ সালের জুন থেকে সীমিত পরিসরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে, এখন পর্যন্ত ৭৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের মে থেকে বড় অঙ্কের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে—এক বছরে প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা।
অর্থবছরভিত্তিক টিকিট বিক্রি থেকে আয়:
২০২২-২৩: ২২ কোটি টাকা
২০২৩-২৪: ২৪৪ কোটি টাকা
২০২৪-২৫ (প্রভিশনাল): প্রায় ৪০০ কোটি টাকা
অন্যদিকে, গত বছর বেতন, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে খরচ হয়েছে ১০০ কোটির বেশি। আগামী বছর থেকে রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতির খরচও আয় থেকেই চালাতে হবে, ফলে মোট ব্যয় ২০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ ও জনবল ব্যয় আরও বাড়বে।
জাইকার ঋণের চাপ, আয় বাড়ানোর তাগিদ
মেট্রোরেল নির্মাণে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি এখন ডিএমটিসিএলকে নিয়মিত পরিশোধ করতে হচ্ছে। নির্মাণকাজ চলাকালীন ১০ বছর কিস্তি না দেওয়ার সুবিধা (গ্রেস পিরিয়ড) থাকলেও ২০২৩ সালের জুন থেকে সীমিত আকারে কিস্তি শোধ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, আর চলতি বছরে আরও ১০ কোটি টাকা দিতে হবে।
তবে ২০২৫ সালের মে মাস থেকে শুরু হচ্ছে বড় অঙ্কের কিস্তি পরিশোধ। ওই সময় থেকে এক বছরের মধ্যে প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ডিএমটিসিএলের সূত্র অনুযায়ী, ২০৩০-৩১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে কিস্তির পরিমাণ আরও বাড়বে। এই সময়ের মধ্যে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৭৪০ কোটি টাকা, মোট ৩,৭০০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করতে হবে জাইকার ঋণ বাবদ।
বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা দরকার:
পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, “মেট্রোরেলের আয় বাড়ানো জরুরি—এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে পরিকল্পনায় যতগুলো দোকান রয়েছে, তার বাইরে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।”
তিনি আরও বলেন, যাত্রী ও সাধারণ মানুষ যেন দোকানগুলো থেকে সঠিক সেবা পান, প্রতারিত না হন, সেটাও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। ব্যবসার নামে বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক প্রভাব বা একজনে দোকান নিয়ে অন্যকে ভাড়া দেওয়ার মতো অনিয়ম রোধে সতর্ক হতে হবে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম যেন যাত্রীসেবা বিঘ্ন না ঘটায়, তেমন নীতিতেই পরিচালিত হওয়া উচিত।