প্রকাশিত : ২৩ এপ্রিল, ২০২৫, ০১:২৭ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আমেরিকা: এক যুদ্ধ-আসক্ত রাষ্ট্রের গল্প

মাসুম বিল্লাহঃ

যখন বিশ্বে যুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ কিংবা বিদেশি অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ আসে, তখন প্রথম যে দেশের নাম উঠে আসে তা হলো আমেরিকা। অবাক করা বিষয় হলো, ২৪৮ বছরের ইতিহাসের মধ্যে ২৩২ বছরই এই দেশটি যুদ্ধের মধ্যে কাটিয়েছে। অর্থাৎ, তাদের ইতিহাসের মাত্র ৬ শতাংশ সময় তারা যুদ্ধহীন থেকেছে। বিষয়টি শুধু একটি দেশের ইতিহাসের অংশ নয়, বরং অনেকেই মনে করেন যুদ্ধই যেন আমেরিকার অস্তিত্বের মূল ভিত্তি।

অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, কেন আমেরিকা ক্রমাগত সরাসরি যুদ্ধ, গোপন অভ্যুত্থান এবং আন্তর্জাতিক সংকটে জড়িয়ে পড়ে। এটা কি শুধুই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, নাকি দেশটির টিকে থাকার কৌশলের অপরিহার্য অংশ? অনেকের ধারণা, যুদ্ধের সঙ্গে আমেরিকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক কৌশল এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, এটি তাদের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য উপাদানে পরিণত হয়েছে।

চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে 'যুদ্ধে আসক্ত' বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমেরিকা বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে তার এই বক্তব্য যে অতিরঞ্জিত নয়, সেটি অনায়াসে বুঝা যায়। ১৭৭৫ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমেরিকা প্রায় সবসময়ই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো যুদ্ধে লিপ্ত থেকেছে।

আমেরিকার আধিপত্যবাদী যুদ্ধের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৮৪৬ থেকে ১৮৪৮ সালের মধ্যে মেক্সিকোর জমি দখল করা হয়, ১৮১১ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত চলে আমেরিকান আদিবাসীদের গণহত্যা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা, শীতল যুদ্ধের সময় কোরিয়া ও ভিয়েতনামে সামরিক হস্তক্ষেপ, ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানো, এসব কিছুই যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধকেন্দ্রিক নীতির স্পষ্ট উদাহরণ।

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমেরিকার আগ্রাসন থামেনি। আফগানিস্তান ও ইরাক দখল, লিবিয়ায় সামরিক অভিযান, ইয়েমেন ও সোমালিয়ায় ড্রোন হামলা, সিরিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে। পাশাপাশি কম্বোডিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার নানা দেশে তাদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সামরিক অভিযান আরও একাধিকবার সংঘটিত হয়েছে।

অনেকে মনে করেন, আমেরিকার এই যুদ্ধনীতি নিরাপত্তা নিশ্চিতে নয়, বরং অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় পরিচালিত হয়। ২০২৩ সালে দেশটির অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩৮ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব অস্ত্র বাজারের ৫১ শতাংশ দখল করে আছে আমেরিকার বিভিন্ন কোম্পানি। যুদ্ধের মাধ্যমে নতুন অস্ত্রের বাজার সৃষ্টি করা, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, কৌশলগত করিডোরের দখল নেওয়া এসবই যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতির পেছনে বড় কারণ। বর্তমানে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে তাদের স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যা তাদের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখতে সহায়তা করছে।

শুধু তাই নয়, আমেরিকা নিজেদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ অন্য জাতিগুলোর ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার একবার বলেছিলেন, আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে যুদ্ধপ্রেমী দেশ, কারণ তারা সবসময় অন্যদের ওপর নিজেদের মূল্যবোধ চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।

বর্তমানে এই যুদ্ধক্ষুধা থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করার হুমকি, পানামা খাল পুনর্দখলের দাবি, এমনকি গ্রিনল্যান্ড কেনার জন্য বারবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যদিও এসব ইস্যু এখন মনস্তাত্ত্বিক ও কৌশলগত পরিকল্পনার স্তরে রয়েছে, তবে ভবিষ্যতে এগুলো সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধ যেন আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ডিএনএর অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। শান্তির প্রয়োজন তাদের নেই, বরং যুদ্ধই তাদের সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি। তবে এই প্রশ্ন থেকেই যায়—এই ধারা কি চিরকাল চলবে? নাকি বিশ্ব একসময় এই যুদ্ধবাজ নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে?

বর্তমানে আমেরিকার ইতিহাস, তাদের রাষ্ট্রীয় কৌশল ও রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, শান্তি তাদের প্রধান লক্ষ্য নয়। বরং যুদ্ধই তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রধান উপায়। তবে ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি কতদিন অব্যাহত থাকবে, তা সময়ই বলে দেবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়