প্রকাশিত : ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৭:৪০ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

লবণের কোন মাত্রা মারাত্মক কম না বেশি?

ছবিঃ সংগ্রহীত।

কিছু বিজ্ঞানীর মতে, কম লবণযুক্ত ডায়েটও অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবারের মতোই ক্ষতিকর হতে পারে। তবে বাস্তবতা কেমন? উদাহরণস্বরূপ: ২০১৭ সালে তুর্কি শেফ নুসরেট গকচে একটি বিশাল স্টেকে লবণ ছিটিয়ে ভিডিও বানিয়েছিলেন। ভিডিওটি মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়, মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ পায় এবং তাকে ‘সল্ট বয়’ হিসেবে পরিচিতি দেয়। এটি তার রান্নার কৌশলের কারণে নয়, বরং মানুষের লবণ নিয়ে অস্বাভাবিক আগ্রহের কারণে ভাইরাল হয়।

আমরা লবণ খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকলেও, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠী প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় দুইগুণ লবণ গ্রহণ করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

লবণ বা সোডিয়াম মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। এটি শরীরের তরল ভারসাম্য বজায় রাখতে, অক্সিজেন ও পুষ্টি পরিবহন করতে এবং স্নায়ুতে বৈদ্যুতিক সংকেত প্রেরণে সাহায্য করে। ইতিহাস জুড়ে মানুষ প্রায়ই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লবণ খেয়েছে, যদিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন।

প্রতিদিন কত লবণ খাওয়া উচিত:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে, দৈনন্দিন খাবারে ২ গ্রাম সোডিয়ামের কম রাখা উচিত, যা প্রায় ৫ গ্রাম লবণের সমান। যুক্তরাষ্ট্রের ডায়েটারি গাইডলাইনস ফর আমেরিকানস অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক সোডিয়াম গ্রহণ ২.৩ গ্রামের কম হওয়া উচিত, যা প্রায় এক চা-চামচ লবণের সমান।

২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক ৩–৬ গ্রাম সোডিয়াম গ্রহণ হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সবচেয়ে উপকারী। এর চেয়ে কম বা বেশি সোডিয়াম গ্রহণ করলে ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক ৬ গ্রাম লবণের বেশি গ্রহণ না করার পরামর্শ দেয়। তবু যুক্তরাজ্যে গড় লবণ গ্রহণ ৮.৪ গ্রাম, যুক্তরাষ্ট্রে ৮.৫ গ্রাম, আর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০.৮ গ্রাম।

দৈনন্দিন লবণের মাত্র এক চতুর্থাংশই সরাসরি খাবারে যোগ করা হয়; বাকি আসে প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে, যেমন:পাউরুটি, সস, স্যুপ ইত্যাদি। ফুড লেবেলে প্রায়ই সোডিয়ামের পরিমাণ লবণের তুলনায় কম দেখানো হয়। ফলে আমরা মনে করি, কম লবণ খাচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে, লবণ মূলত সোডিয়াম ও ক্লোরাইড আয়ন নিয়ে গঠিত। উদাহরণস্বরূপ:২.৫ গ্রাম লবণে প্রায় ১ গ্রাম সোডিয়াম থাকে।

ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে সোডিয়ামের প্রায় ৪০% আসে পিজ্জা, ডেলি মিট, বারিটো, ট্যাকো, স্যাভরি স্ন্যাকস, পোল্ট্রি এবং বার্গারের মতো খাবার থেকে। এক মেটা-অ্যানালাইসিসে দেখা গেছে, দৈনিক ৫ গ্রাম অতিরিক্ত লবণ হৃদরোগের ঝুঁকি ১৭% বাড়ায়।

অতিরিক্ত লবণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি:
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে, যা স্ট্রোক ও হৃদরোগের কারণ হতে পারে। লবণ খেলে শরীর পানি ধরে রাখে, ফলে রক্তচাপ বাড়ে যতক্ষণ না কিডনি তা বের করে। দীর্ঘ সময় অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ ধমনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন) হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী, অতিরিক্ত সোডিয়াম প্রতি বছর প্রায় ১৮.৯ লাখ মৃত্যুর কারণ।

তেরোটি গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক ৫.০গ্রাম অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ মোট কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি ১৮% এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৪% বাড়ায়।

লবণ কম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারিতা:
লবণ কম খাওয়া স্বাস্থ্যের বিপরীত প্রভাব ফেলে। হেলথ সার্ভে ফর ইংল্যান্ডের ৭/৮  বছরের ডেটা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দৈনিক ১.৫ গ্রাম লবণ রক্তচাপ হ্রাসে অবদান রেখেছে, যেটি স্ট্রোকে৪২% এবং হৃদরোগ জনিত মৃত্যুর ৪০% কমাতে সাহায্য করেছে।

২০২৩ সালের একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের কম-সোডিয়াম ডায়েট রক্তচাপ কমাতে একটি সাধারণ প্রেসার ওষুধের মতোই কার্যকর। তবে পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা লবণ কম খায়, তারা সাধারণত স্বাস্থ্যকর জীবনধারা পালন করে সুস্থ খাদ্য, ব্যায়াম, কম ধূমপান ও অ্যালকোহল। তাই শুধুমাত্র লবণ কমানোর প্রভাব আলাদা করা কঠিন।

র‍্যান্ডমাইজড ট্রায়াল যেখানে বেশি লবণ ও কম লবণ গ্রুপের তুলনা করা হয়, তা কারণ ও ফলাফল নির্ধারণে সহায়ক, কিন্তু এ ধরনের গবেষণা খুবই সীমিত, কারণ তহবিল ও নৈতিক জটিলতা বেশি।

ওয়ারউইকের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রান্সেস্কো ক্যাপুচ্চিও বলেন, লবণ গ্রহণের প্রভাব দেখানোর জন্য র‍্যান্ডমাইজড ট্রায়াল করা প্রায় অসম্ভব। তবে পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ প্রচুর। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬০-এর দশকে জাপানে লবণ কমানোর প্রচারণা চালানোর পর রক্তচাপ কমে যায় এবং স্ট্রোকজনিত মৃত্যুহার ৮০% হ্রাস পায়। ফিনল্যান্ডে ১৯৭০-এর দশকের শেষে দৈনিক লবণ ১২ গ্রাম থেকে ৯ গ্রামে নেমে আসে, এবং স্ট্রোক ও হৃদরোগজনিত মৃত্যু ৭৫–৮০% কমে।

লবণ খাওয়ার প্রভাব ব্যক্তিভেদে ভিন্ন:

লবণের প্রভাব সব ব্যক্তির জন্য একই নয়। এটি নির্ভর করে জাতি, বয়স, বিএমআই, স্বাস্থ্য ও পারিবারিক হাইপারটেনশন ইতিহাসের ওপর।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, লবণের প্রতি সংবেদনশীলদের ঝুঁকি বেশি। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, কম লবণযুক্ত ডায়েটও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ঝুঁকির একটি ‘U’ বা ‘J’ আকৃতির বাঁক রয়েছে, যেখানে মাঝারি লবণ গ্রহণে ঝুঁকি কম, দুইপাশে ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

মেটা-অ্যানালাইসিস দেখিয়েছে, দৈনিক ৫.৬ গ্রাম কম বা ১২.৫ গ্রাম বেশি লবণ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ২০২০ সালের গবেষণা দেখিয়েছে, কঠোর লবণ সীমাবদ্ধতা যুবক ও অ-সাদা রোগীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এন্ড্রু মেন্টে বলেন, উচ্চ থেকে মাঝারি লবণ গ্রহণে ঝুঁকি কমে, তবে কম থেকে মাঝারি লবণেও উপকার হতে পারে। তিনি যোগ করেন, যেকোনো পুষ্টি উপাদানের ক্ষেত্রে মাঝারি স্তরই সর্বোত্তম।

ক্যাপুচ্চিও স্পষ্টভাবে বলেন, লবণ কমানো সব মানুষের রক্তচাপ কমায় শুধু যারা অতিরিক্ত লবণ খান তাদের নয়।

ব্রিটিশ নিউট্রিশন ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞান পরিচালক সারা স্ট্যানার বলেন, হাইপারটেনশন থাকা মানুষের মধ্যে লবণ কমানো রক্তচাপ ও হৃদরোগ ঝুঁকি কমাতে প্রমাণ শক্তিশালী। খুব কম মানুষ দৈনিক ৩ গ্রাম লবণ খায়, যা কিছু গবেষণায় বিপজ্জনকভাবে কম বলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের জানা উচিত, খাদ্যের লবণ অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে থাকে। তাই খাবারের যোগান শৃঙ্খলে পুনর্গঠন জাতীয় লবণের মাত্রা কমানোর সবচেয়ে সফল উপায়।

বিশেষজ্ঞদের মত:
উচ্চ লবণ গ্রহণ কি স্বাস্থ্যকর ডায়েট ও ব্যায়ামের মাধ্যমে সামঞ্জস্য করা যায়? বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ আছে। কিছু বিশেষজ্ঞ বলেন, পটাসিয়াম সমৃদ্ধ ফল, সবজি, বাদাম ও দুগ্ধজাত খাবার রক্তচাপে লবণের ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা কমাতে পারে।

ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেউ মাতেউস বলেন, আমাদের উচিত লুকানো লবণ সম্পর্কে সচেতন থাকা, পুরোপুরি এড়ানোর চেষ্টা নয়। অতিরিক্ত লবণের সমস্যা কম লবণের সমস্যা সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে, তবে আরও গবেষণার প্রয়োজন। একজন সুস্থ ব্যক্তি লবণের পরিমাণ  নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।

সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, হৃদরোগ ঝুঁকি কমাতে দৈনিক ৩–৬ গ্রাম সোডিয়াম গ্রহণ সবচেয়ে উপকারী। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানাচ্ছে, কম লবণও কিছু ক্ষতি করতে পারে, তবে অতিরিক্ত লবণ পরিষ্কারভাবে রক্তচাপ বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়