প্রকাশিত : ২৬ এপ্রিল, ২০২৫, ০৪:০২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে জমে উঠেছে বুড়া চিন্তামন ঘোড়ার মেলা

মোঃ রুবেল হোসেন, দিনাজপুর থেকেঃ
 
এই গরমের মাঝেও দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বুড়াচিন্তামন ঘোড়ার মেলা জমে উঠেছে। মাসব্যাপী এ মেলা উপভোগ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।ফুলবাড়ী শহর থেকে ৮/৯ কি.মি.দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং বারাই হাট থেকে ৫/৬ কি.মি.দক্ষিণে ২ নম্বর আলাদীপুর ইউনিয়নে ২শ’ বছর ধরে বসে এই ঐতিহ্যবাহী বুড়াচিন্তামন মেলা।


নববর্ষ ১৪৩২  বাংলা নতুন সন হিসেবে বৈশাখ মাসের ৯/১০ তারিখ থেকে শুরু হয় মাসব্যাপী এই মেলা। বৈশাখ মাসের ১৩ তারিখ থেকে কেনাবেচার রসিদ কাটা হয়(ছাপা বের হয়)। মূল মেলা এক মাস হলেও পশুর মেলা হয় ১০ থেকে ১২দিন। ঘোড়া ছাড়াও মহিষ, গরু, ভেড়া ও ছাগল বেচাকেনা হয় এ মেলায়।তবে এখন গরু-মহিষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মূলত ঘোড়ার মেলা হিসেবেই বেশি প্রসিদ্ধ।

বুড়া চিন্তামন মেলার আয়োজকরা বলছেন, দেশের অন্যতম ঘোড়া বেচাকেনার মেলা এটি।এই মেলার জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে ৮ একর জমি-মাঠ।এখানে মাদরাসা-স্কুলের প্রশস্ত মাঠে যেমন হাট বসে তেমনি তহসিল অফিস,ডাকঘর,সমবায় অফিস,ক্লিনিক,খেলার মাঠ,ইউপি অফিস এসবের কারণে জনগুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে পরিণত হয়েছে। এ কারণে সারাদেশ থেকে আনা কয়েক শ’ ঘোড়া জড়ো করা হয় এখানে। এটিকে ঘোড়ার মিলনমেলা বললেও অত্যুক্তি হবে না।

প্রতিটি ঘোড়ার মালিক নির্দিষ্ট নাম ধরে শখের ঘোড়াকে ডাকছে যেমন দুমকি,সিডর,দুর্বার,বিজলি, কিরন মালা, রানী, সুইটি আরও কত যে বাহারি নাম। ওদের ক্ষিপ্রতা আর বুদ্ধিমত্তায়ও মেলে নামের সার্থকতা। ঘোড়াগুলোর দুলকী চলনে বিদ্যুৎ গতি, চোখের পলকে যেন মাইল পার। এমন নানামুখী গুণের কারণে দেশি-বিদেশি ঘোড়াগুলোর কদরও যথেষ্ট। পছন্দের ঘোড়াকে পেতে ক্রেতাদের মধ্যেও চলে রীতিমতো কাড়াকাড়ি আর দর কষাকষি। ক্রেতা বিক্রেতা ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর ঐতিহ্যবাহী বুড়াচিন্তামন ঘোড়ার মেলা । দরদাম ঠিকঠাকের পর একটি খেলার মাঠে ঘোড়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ক্রেতাকে দেখানো হয় ঘোড়ার দৌড়।

৭৮ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও সাবেক আলাদীপুর ইউপি চেয়ারম্যান মে. দছিম উদ্দীন মন্ডল  জানান, এ মেলায় লালমনির হাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, ঠাকুগাঁও, বগুড়া, দিনাজপুর, পাবনা, জয়পুর হাট, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘোড়ার আমদানি হয়।

পার্বতীপুর থেকে এসেছেন সামসুল হক (৫০)।১৭ মাস বয়সের দৃষ্টিনন্দন ঘোড়াটি তিনি বিক্রি করতে এনেছেন।নাম রাখেননি।আড়াই লাখ টাকা দাম চান। একই উপজেলার মধ্যপাড়া থেকে পিকাপে করে এনেছেন ৭ টি ঘোড়া। সবেমাত্র ঘরঘাট ঠিক করছেন। নবাবগঞ্জ উপজেলার স্বপ্নপুরী থেকে আবুল কালাম এনেছেন ১টি ঘোড়া। দাম চাচ্ছেন দেড় লাখ। একই উপজেলার নারানপুর থেকে এসেছেন ওয়াজেদ মিয়া কয়েকটি ঘোড়া নিয়ে।

বগুড়া থেকে আজাদ হোসেন ‘সম্রাট’ নামের ৫ বছর বয়সের লাল ঘোড়া নিয়ে এসেছেন । দাম রেখেছেন ৩ লাখ। ২ লাখ পর্যন্ত করছেন। এটি রেসিং ঘোড়া। দ্রত দৌঁড়াতে পারে ।ঘোড়াটির যত্ন তিনি নিজেই নেন। ৪০ বছর ধরে এ মেলায় আসেন বলে জানালেন।”

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থেকে আসা মকছেদ আলী ৫টি, সুরুজ মিয়া ৮ টি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন বৃহস্পতিবার। এখনো বিক্রি করার মত আলাপ করতে পারেননি।তবে বিকেল কিংবা আগামী কালের মধ্যে হয়ে যাবে বলে আশা করছেন। গাইবান্ধা থেকে আসা সেহাগ,ছমেজ উদ্দীন জানান, তিনি ২৫ বছর ধরে মেলায় ঘোড়া নিয়ে আসেন এখানে। এবার তিনি চারটি ঘোড়া এনেছেন, সবগুলো বিক্রি করবেন।

ঘোড় সওয়ারি কামরুজ্জামান,সামছুল ,রংপুরের রফিকুল ইসলাম ক্রেতা-বিক্রেতারা জানান, আগেও তাদের বাপ-দাদারা এ মেলায় ঘোড়া কেনাবেচা করতেন, পূর্ব পুরুষের সূত্র ধরে তারাও আগলে রেখেছেন সেই পারিবারিক ঐতিহ্য। আগে ঘোড়ার হাট ও ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ঘোড় দৌড়ের বিস্তীর্ণ মাঠ থাকলেও বর্তমানে সেই স্থানটি সংকুচিত করা হয়েছে বলে ঘোড়া বেচাকেনায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।

মেলার ইজারাদার সফিকুল ইসলাম, ওয়াজেদ আলী এবং রুবেল হোসেন বলেন, ঐতিহ্যবাহী বুড়াচিন্তামন ঘোড়ার মেলা সুষ্ঠুভাবে হওয়ার জন্য বিদ্যুৎ,পানি,২০০ শ’ ভলেনটিয়ার নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। মেলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কেনাবেচার রসিদ মূল্য সহনীয় রাখা হবে।

২ নম্বর আলাদীপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও মেলা কমিটির অন্যতম মো. নাজমুস সাকির বাবলু জানান, প্রশাসনের পাশাপাশি মেলা কমিটিও সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। এতো বড় পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ মেলা উত্তরবঙ্গের অন্যতম বলেও জানান তিনি।

ফুলবাড়ী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বুড়াচিন্তামন ঘোড়ার মেলা কমিটির সভাপতি শিক্ষক আফতাব উদ্দিন জানান, ২শ’ বছরের পুরনো এ মেলা শুরু থেকেই ঘোড়ার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। স্বাধীনতার পরও মেলায় নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে উন্নত জাতের ঘোড়া আসত। বর্তমানে সেসব এখন স্মৃতির পাতায় হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঘোড় সওয়ারি ও ঘোড়া মালিকরা এ মেলায় ঘোড়া নিয়ে আসেন।

ফুলবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম খন্দকার মুহিব্বুল জানান, আমাদের সহযোগিতা চাইলে ঐতিহ্যবাহী বুড়াচিন্তামন ঘোড়ার মেলাটি নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশের পাশাপাশি আনসার মোতায়েন করা হবে।

ইউএনও মো. ইসাহাক আলী বলেন, মেলা কমিটি ডিসি অফিস থেকে মেলার জন্য অনুমোদন নিয়েছে। ফুলবাড়ী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বুড়াচিন্তামন ঘোড়ার মেলাটি সুষ্ঠুভাবে কেনাবেচা সম্পন্ন হওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়