মাসুম বিল্লাহঃ
বাংলাদেশকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য আদর্শ জায়গা বলা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস, যে সমাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি বেশি, সেখানেই সত্য সন্ধানী, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো মানুষের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ কমে আসলেও অসৎ মানুষের সংখ্যা কমছে না—এমন কথা প্রায়ই শোনা যায় চায়ের দোকান বা লোকাল বাসের আলোচনায়। খাদ্য থেকে শুরু করে ওষুধ—প্রায় প্রতিটি জিনিসেই মিশ্রিত রয়েছে ভেজাল ও প্রতারণা। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ডাক্তার, আমলা—সবাই যেন লোভের দৌড়ে একে অপরকে ফাঁকি দিতে নতুন নতুন উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এই কারণেই, এ দেশের জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক ও জরুরি।
বিশ্বের অনেক দেশেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস হয়েছে। কেউ কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কেউবা জেল খেটেছেন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্টকেও পদত্যাগ করতে হয়েছে (ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি) সাংবাদিকতার চাপে পড়ে।
২০১৮ সালে পোল্যান্ডে এক সাংবাদিক ছদ্মবেশে কসাইখানায় কাজ করে মৃত ও অসুস্থ গরুর মাংস বাজারজাত করার তথ্য ফাঁস করেন। তার সংগ্রহ করা ১২০ ঘণ্টার ভিডিওর প্রভাবে ইউরোপজুড়ে পোলিশ গরুর মাংসের বাজারে ধস নামে। সরকারের কর্মকর্তারাও চাকরি হারান।
এর আগে, খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের দ্বারা শিশু নিপীড়নের ঘটনা ফাঁস করে মার্কিন পত্রিকা বস্টন গ্লোব। সাংবাদিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই সমাজের লুকানো অন্যায় প্রকাশ্যে আসে।
জার্নালিজমের ইতিহাসে আরেকটি বড় ঘটনা হলো ‘ওয়াটারগেট’। একটি সাধারণ চুরির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা আবিষ্কার করেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গভীর ষড়যন্ত্র। এর ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
উন্নত দেশে সাংবাদিকদের ‘ওয়াচডগ’ বলা হয়—অর্থাৎ সমাজের প্রহরী। সবাই যখন ঘুমায়, সাংবাদিক তখন জেগে থাকে, সত্য খুঁজে বের করার জন্য।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ছদ্মবেশী অনুসন্ধানও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যেমন, বিখ্যাত সাংবাদিক নেলি ব্লাই মানসিক রোগী সেজে ১০ দিন হাসপাতালে থেকে নির্যাতনের সত্য বের করেছিলেন।
জনস্বার্থে সাংবাদিকতা করতে হলে সাহস লাগে। ওয়াশিংটন পোস্ট যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধের গোপন নথি প্রকাশ করেছিল, তেমনি আমাদের দেশের সাংবাদিকদেরও অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দুর্নীতিবাজদের স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে সাহসের সঙ্গে।
একইভাবে, আইনজীবীরাও সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। সাংবাদিক ও আইনজীবীর যৌথ প্রয়াসেই সমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
আঠারো শতকে যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকেরা মাকরেকিং সাংবাদিকতা শুরু করেন—যেখানে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের মুখোশ উন্মোচন করা হতো। এই ঐতিহ্য আজও অনুসরণীয়।
বাংলাদেশকে সত্যিকারের ‘সোনার বাংলা’ বানাতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাহসী সাংবাদিকতা দরকার। সাংবাদিকরা যদি সত্যের কলম হাতে অনিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তবে পরিবর্তন নিশ্চিতভাবেই আসবে।