জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নিয়ে কৌতূহল ততই বাড়ছে তারা আসলে কার সঙ্গে জোট বাঁধতে যাচ্ছেন? রাজনৈতিক অঙ্গনে ধারণা, মুখে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিলেও দলগুলো ইতোমধ্যেই নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছে। জুলাই সনদ ও নির্বাচন ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকলেও দ্রুতই এর সমাধান হবে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের তিন প্রধান শক্তি এক ধরনের সমঝোতার পথে হাঁটছে বলেই আলোচনা চলছে। একই সঙ্গে জোট গঠন ও আসন সমঝোতা নিয়েও পর্দার আড়ালে চলছে নীরব আলাপ-আলোচনা।
তথ্যমতে, পৃথক জোট গঠনে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি সবচেয়ে সক্রিয়। পাশাপাশি বাম, ডান ও ইসলামপন্থী কয়েকটি দলও আরও দুটি জোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজনৈতিক সূত্র বলছে, জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের টানাপোড়েন নিরসনে পশ্চিমা কূটনীতিকরাও এগিয়ে এসেছেন। তারা দুই দলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান জানাচ্ছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ নেতাদের নিউইয়র্কে যাওয়া কাকতালীয় নয়। এ সফরকে ঘিরে নানান গুঞ্জন ছড়ালেও ধারণা করা হচ্ছে, পারস্পরিক আস্থা সংকট নিরসনেই এই যৌথ উপস্থিতি। জুলাই সনদ ও নির্বাচন ইস্যুতে ভিন্নমত থাকলেও বিদেশ সফরে আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান হতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি, দেশে ফেরার পর তাদের রাজনৈতিক পদক্ষেপে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জনগণ আর কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখতে চায় না। তাই রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হলো রাজপথে সংঘাতে না গিয়ে আলোচনার টেবিলে সমস্যার সমাধান করা।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ছোট দল ও সংগঠনগুলোকে পাশে টানতে তৎপর হয়ে উঠেছে। এজন্য ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে একাধিক জোট ও পক্ষ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে যেসব দল বিএনপির সঙ্গী ছিল, তাদের সঙ্গে এখনও সম্পর্ক অটুট রেখেছে দলটি। তবে নির্বাচন সামনে রেখে পুরনো সঙ্গীদের বাইরেও নতুন কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে বিএনপি। সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও মিত্রদের আসন ছাড় দেওয়ার প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছে। সব ঠিক থাকলে অক্টোবরেই মিত্রদের জন্য কতটি আসন ছাড় দেওয়া হবে তা চূড়ান্ত করবে বিএনপি।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী নতুন ফ্রন্ট কিংবা নির্বাচনী সমঝোতার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত। এর বাইরে বাম ও মধ্যপন্থী কয়েকটি দল তৃতীয় একটি জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। আবার বাম ও ইসলামি ধারার কয়েকটি দল পৃথক জোট গঠনের পথে অনেকটাই অগ্রসর। ফলে ভোটের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে।
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদের একীভূত হওয়ার সম্ভাবনাও আলোচনায় এসেছে। অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছেন দুই দলের নেতারা। তবে একীভূত হলে নাম কী হবে কিংবা শীর্ষ পদে কারা থাকবেন সেসব বিষয়ে এখনো সমঝোতা হয়নি।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান জানান, তরুণরা ইতিবাচকভাবে ঐক্যের পথে এগোচ্ছে। ‘যদি-কিন্তু’ বাদ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ যাত্রা শুরু হলে দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। তিনি আরও বলেন, এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের কর্মীদের একসঙ্গে রাজপথে লড়াইয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে, যা ভবিষ্যৎ ঐক্যকে সহজতর করবে। তার ভাষায়, একীভূত হওয়ার বিষয়ে দুই দলের নেতাদের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে।
শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর স্পষ্ট করে জানান আসন ভাগাভাগি নিয়ে এখনো কোনো দলের সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। তবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে আলাপ চলছে, আর সন্তোষজনক অগ্রগতি হলে সেটি প্রকাশ্যে জানানো হবে।
এদিকে ইসলামপন্থি ভোটকে এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। অন্তত সাতটি দল অভিন্ন কর্মসূচিতে মাঠে সক্রিয় হলেও তাদের মধ্যে একটির নেতারা এখনও দ্বিধায় জামায়াতের সঙ্গে যাবে, নাকি বিএনপির জোটে যুক্ত হবে। ওই দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপির দিকেই ঝুঁকতে পারেন তারা। এই প্রেক্ষাপটে পাল্টা কৌশল নিয়েছে বিএনপি। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে তারা গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের বাবুনগর মাদরাসা এবং সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্যন্ত। যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ দাবি করেছেন, হেফাজত রাজনৈতিক দল নয়, তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কেবল শারীরিক খোঁজখবর নিতে। তবে স্বীকার করেছেন, হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে আলাপ চলছে।
এর পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও ছারছীনা পীরের সঙ্গেও বিএনপির বৈঠক হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব সংগঠনের নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক থাকায় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে এগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, এগুলো ঐতিহাসিকভাবে জামায়াতবিরোধী ধারা বহন করে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির নেতাদের এসব সংগঠনের সম্মেলন ও সভায় উপস্থিতি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
অন্যদিকে নতুন জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে নয়টি রাজনৈতিক দল এর মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় শরিক, জাতীয় নাগরিক পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টি। তারা ইতোমধ্যে বৈঠকও করেছে। তবে কিছু দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, তাদের লক্ষ্য সরাসরি জোট নয়, বরং জুলাই সনদ ও নির্বাচন নিয়ে ঐক্যমত্য গড়া। ধাপে ধাপে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গেও বসার পরিকল্পনা আছে তাদের। যদিও বাম ধারার কিছু দল জামায়াতের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় রাজি নন।
জানা গেছে, বিএনপি আগেই ঘোষণা দিয়েছে যদি জয়ী হয় তবে গণতন্ত্র মঞ্চকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করবে। তবে জুলাই সনদ ইস্যুতে মঞ্চের কিছু দলের অবস্থান বিএনপির সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। এর মধ্যেই মঞ্চের অন্তত তিনটি দল আবার সরাসরি বিএনপির জোটে যেতে আগ্রহী বলে ইঙ্গিত মিলছে।
সব মিলিয়ে নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠে জোট-সমীকরণ নতুন মোড় নিচ্ছে। কে কার সঙ্গে যাবে, আর কোন সেতু ভেঙে নতুন সেতু গড়ে উঠবে এখন সেদিকেই তাকিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জানিয়েছে, জোট বা নির্বাচনি সমঝোতা নিয়ে তাদের দলে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
অন্যদিকে নির্বাচনের আগে বাম ধারার সব দল ও সংগঠনকে এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। বাম গণতান্ত্রিক জোটের ছয় দল বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, সমাজতান্ত্রিক পার্টি ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ এরই মধ্যে আলোচনায় রয়েছে। শুধু তাই নয়, আদিবাসী সংগঠন, দলিত সংগঠন ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মগুলোকেও এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ চলছে। পাশাপাশি কয়েকটি ইসলামি দলের মধ্যেও পৃথক জোট গঠনের আলোচনা এগোচ্ছে বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, জুলাই সনদ ও আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা অপরিহার্য। তার ভাষায়, “৫ আগস্টের পর দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বদলে গেছে। জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হলে এমন একটি নির্বাচনের দিকে যেতে হবে, যেখানে সব নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। বড় বড় ইস্যুতে দলগুলোর অবস্থান ভিন্ন হলেও আলোচনা ছাড়া কোনো পথ নেই। বর্তমানে যারা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে, তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
তার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, নির্বাচন সামনে রেখে অন্তত তিনটি বড় জোট গড়ে উঠতে পারে,বিএনপি ও তাদের মিত্র উদার গণতান্ত্রিক দলগুলো নিয়ে একটি জোট,জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামি কয়েকটি দলকে নিয়ে আরেকটি জোট,এবং বাম ধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নিয়ে তৃতীয় একটি জোট।
এর বাইরে বাম-ডান, মধ্যপন্থী ও ইসলামি দলগুলো মিলে আরও দুটি জোটের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ভোটের রাজনীতির মাঠে বহুজোটের সমীকরণ তৈরি হচ্ছে, যার চূড়ান্ত চিত্র পরিষ্কার হবে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলে।